শনিবার, ১২ নভেম্বর, ২০২২

বাংলা বানানের প্রাথমিক নিয়ম

লেখার ক্ষেত্রে আমরা বানান নিয়ে প্রায় বিভ্রান্তিতে পড়ি। এই বিভ্রান্তি দূর করার জন্য বানানের নিয়ম জানা আবশ্যক। শুদ্ধ বানানের সঠিক নিয়ম জানা না থাকলে অর্থ-বিভ্রান্তি ঘটে এবং ভাষার সৌকর্য নষ্ট হয়। বাংলা বানানের রয়েছে সুপরিকল্পিত নিয়ম। 

 আজ আমরা বাংলা বানানের প্রাথমিক কিছু নিয়ম আলোচনার চেষ্টা করবো। 

 • মূর্ধন্য ণ, দন্ত্য ন 
. ঋ, র (্র),রেফ (র্), ষ (ক্ষ) বর্ণের পরে দন্ত্য-ন মূর্ধন্য-ণ হয়। যেমন: ঋণ,তৃণ, বর্ণ, বিষ্ণু, বরণ, ঘৃণা।

২. যদি ঋ, র(্র), ষ(ক্ষ) বর্ণের পরে স্বরবর্ণ, ক-বর্গ, প-বর্গ, য, ব, হ, য় অথবা অনুস্বার (ং) থাকে, তার পরবর্তী দন্ত্য-ন মূর্ধন্য-ণ হয়ে যায়। যেমন: কৃপণ, নির্বাণ, গ্রহণ। 

৩. তৎসম শব্দে ট ঠ ড ঢ-এর পূর্বে যুক্ত নাসিক্যবর্ণ ণ হয়। যেমন: কণ্টক, প্রচণ্ড, লুণ্ঠন। ৪. কিন্তু অতৎসম শব্দের ক্ষেত্রে ট ঠ ড ঢ-য়ের আগে কেবল ন হবে। যেমন: গুন্ডা, ঝান্ডা, ঠান্ডা, ডান্ডা, লন্ঠন। 

 ৫. অতৎসম শব্দের বানানে ‘ন’ ব্যবহার হবে। যেমন: অঘ্রান, ইরান, কান, কোরান, গভর্নর, গুনতি, গোনা, ঝরনা, ধরন, পরান, রানি, সোনা, হর্ন।

• শ, ষ, স

৬. ঋ-কারে পরে মূর্ধন্য-ষ হয়। যেমন: ঋষি, বৃষ, বৃষ্টি। নিঃ, দুঃ, বহিঃ, আবিঃ, চতুঃ, প্রাদুঃ এ শব্দগুলোর পর ক্, খ্, প্, ফ্ থাকলে বিসর্গ (ঃ) এর জায়গায় মূর্ধন্য-ষ হয়। যেমন: নিঃ + কাম > নিষ্কাম, দুঃ + কর > দুষ্কর, বহিঃ + কার > বহিষ্কার, নিঃ + পাপ > নিষ্পাপ। * বিদেশি শব্দের ক্ষেত্রে ‘ষ’ ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। যেমন: কিশমিশ, নাশতা, পোশাক, বেহেশ্ত, শখ, শয়তান, শরবত, শরম, শহর, শামিয়ানা, শার্ট, শৌখিন; আপস, জিনিস, মসলা, সন, সাদা, সাল (বৎসর), স্মার্ট, হিসাব; স্টল, স্টাইল, স্টিমার, স্ট্রিট, স্টুডিয়ো, স্টেশন, স্টোর। ইসলাম, তসলিম, মুসলমান, মুসলিম, সালাত, সালাম; এশা, শাওয়াল (হিজরি মাস), শাবান (হিজরি মাস)। 



 ৭. ইংরেজি ও ইংরেজির মাধ্যমে আগত বিদেশি s ধ্বনির জন্য স এবং -sh, -sion, -ssion, tion প্রভৃতি বর্ণগুচ্ছ বা ধ্বনির জন্য শ ব্যবহৃত হবে। যেমন: পাসপোর্ট, বাস; ক্যাশ; টেলিভিশন; মিশন, সেশন; রেশন, স্টেশন। 

 ৮. যেখানে বাংলায় বিদেশি শব্দের বানান পরিবর্তিত হয়ে স ছ এর রূপ ধারণ করেছে সেখানে ছ-এর ব্যবহার থাকবে। যেমন: তছনছ, পছন্দ, মিছরি, মিছিল। 

 ৯. দূরত্ব বোঝায় না এরূপ শব্দে উ-কার যোগে ‘দুর’ (‘দুর’ উপসর্গ) বা ‘দু+রেফ’ হবে। যেমন— দুরবস্থা, দুরন্ত, দুরাকাঙ্ক্ষা, দুরারোগ্য, দুরূহ, দুর্গা, দুর্গতি, দুর্গ, দুর্দান্ত, দুর্নীতি, দুর্যোগ, দুর্ঘটনা, দুর্নাম, দুর্ভোগ, দুর্দিন, দুর্বল, দুর্জয় ইত্যাদি। 

 ১০. দূরত্ব বোঝায় এমন শব্দে ঊ-কার যোগে ‘দূর’ হবে। যেমন— দূর, দূরবর্তী, দূর-দূরান্ত, দূরীকরণ, অদূর, দূরত্ব, দূরবীক্ষণ ইত্যাদি। 

 ১১. পদের শেষে ‘-জীবী’ ঈ-কার হবে। যেমন— চাকরিজীবী, পেশাজীবী, শ্রমজীবী, কৃষিজীবী, আইনজীবী ইত্যাদি। 

১২. পদের শেষে’-গ্রস্থ’ নয় ‘-গ্রস্ত’ হবে। যেমন— বাধাগ্রস্ত, ক্ষতিগ্রস্ত, হতাশাগ্রস্ত, বিপদগ্রস্ত ইত্যাদি। 

 ১৩. অঞ্জলি দ্বারা গঠিত সকল শব্দে ই-কার হবে। যেমন— অঞ্জলি, গীতাঞ্জলি, শ্রদ্ধাঞ্জলি ইত্যাদি।

 ১৪. শ, ষ, স তৎসম শব্দে ষ ব্যবহার হবে। খাঁটি বাংলা ও বিদেশি শব্দে ষ ব্যবহার হবে না। বাংলা বানানে ‘ষ’ ব্যবহারের জন্য অবশ্যই ষত্ব-বিধান, উপসর্গ, সন্ধি সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। বাংলায় অধিকাংশশব্দের উচ্চারণে ‘শ’ বিদ্যমান। এমনকি ‘স’ দিয়ে গঠিত শব্দেও ‘শ’ উচ্চারণ হয়। ‘স’-এর স্বতন্ত্র উচ্চারণ বাংলায় খুবই কম। ‘স’-এর স্বতন্ত্র উচ্চারণ হচ্ছে— সমীর, সাফ, সাফাই। যুক্ত বর্ণ, ঋ-কার ও র- ফলা যোগে যুক্তধ্বনিতে ‘স’-এর উচ্চারণ পাওয়া যায়। যেমন— সৃষ্টি, স্মৃতি, স্পর্শ, স্রোত, শ্রী, আশ্রম ইত্যাদি। 


 ১৫. বিশেষণবাচক আলি প্রত্যয়যুক্ত শব্দে ই-কার হবে। যেমন— সোনালি, রুপালি, বর্ণালি, হেঁয়ালি, খেয়ালি, মিতালি ইত্যাদি। 

 ১৬. জীব, -জীবী, জীবিত, জীবিকা ব্যবহার। যেমন— সজীব, রাজীব, নির্জীব, চাকরিজীবী, পেশাজীবী, জীবিত, জীবিকা। 

 ১৭. অদ্ভুত, ভুতুড়ে বানানে উ-কার হবে। এ ছাড়া সকল ভূতে ঊ-কার হবে। যেমন— ভূত, ভস্মীভূত, বহির্ভূত, ভূতপূর্ব ইত্যাদি। 

 ১৮. হীরা ও নীল অর্থে সকল বানানে ঈ-কার হবে। যেমন— হীরা, হীরক, নীল, সুনীল, নীলক, নীলিমা ইত্যাদি। 

 ১৯. ত্ব, তা, নী, ণী, সভা, পরিষদ, জগৎ, বিদ্যা, তত্ত্ব শব্দের শেষে যোগ হলে ই-কার হবে। যেমন— দায়িত্ব (দায়ী), প্রতিদ্বন্দ্বিতা (প্রতিদ্বন্দ্বী), প্রার্থিতা (প্রার্থী), দুঃখিনী (দুঃখী), অধিকারিণী (অধিকারী), সহযোগিতা (সহযোগী), মন্ত্রিত্ব, মন্ত্রিসভা, মন্ত্রিপরিষদ (মন্ত্রী), প্রাণিবিদ্যা, প্রাণিতত্ত্ব, প্রাণিজগৎ, প্রাণিসম্পদ (প্রাণী) ইত্যাদি। 

 ২০. ঈ, ঈয়, অনীয় প্রত্যয় যোগ ঈ-কার হবে। যেমন— জাতীয় (জাতি), দেশীয় (দেশি ), পানীয় (পানি), জলীয়, স্থানীয়, স্মরণীয়, বরণীয়, গোপনীয়, ভারতীয়, মাননীয়, বায়বীয়, প্রয়োজনীয়, পালনীয়, তুলনীয়, শোচনীয়, রাজকীয়, লক্ষণীয়, করণীয়। 

২১. ব্যক্তির ‘-কারী’-তে (আরী) ঈ-কার হবে। যেমন— সহকারী, আবেদনকারী, ছিনতাইকারী, পথচারী, কর্মচারী ইত্যাদি। ব্যক্তির ‘-কারী’ নয়, এমন শব্দে ই-কার হবে। যেমন— সরকারি, দরকারি ইত্যাদি। 

২২. প্রমিত বানানে শব্দের শেষে ঈ-কার থাকলে –গণ যোগে ই-কার হয়। যেমন— সহকারী>সহকারিগণ, কর্মচারী>কর্মচারিগণ, কর্মী>কর্মিগণ, আবেদনকারী>আবেদনকারিগণ ইত্যাদি। 

  
প্রয়োজনীয় কিছু শুদ্ধ বানানঃ

১. উজ্জ্বল, জ্বলজ্বলে, জ্বলন্ত, জ্বালানি, প্রাঞ্জল, অঞ্জলি, শ্রদ্ধাঞ্জলি,গীতাঞ্জলি। 

২. পেশাজীবী, কর্মজীবী, ক্ষণজীবী, দীর্ঘজীবী, বুদ্ধিজীবী, অভিমানী, প্রতিদ্বন্দ্বী, প্রতিযোগী, মেধাবী, প্রতিরোধী একাকী, দোষী, বৈরী, মনীষী, সঙ্গী। 

৩. উন্নয়নশীল, দানশীল, উৎপাদনশীল, ক্ষমাশীল, নির্ভরশীল, দায়িত্বশীল, সুশীল, ধৈর্যশীল। 

 ৪. অধ্যক্ষ, প্রতীক, ব্যাখ্যা,আকস্মিক, মূর্ছা, ক্ষীণ, মুখমণ্ডল, অনুরণন, হাস্যাস্পদ, সালিস, সত্বর, উচ্ছ্বসিত, স্বেচ্ছাচারী, কর্মচারী,বিচি, বাণী, শ্বশুর,শাশুড়ি ।

 ৫. ইতোমধ্যে, পরিপক্ব, লজ্জাকর, ভাস্কর, দুষ্কর, সুষমা, নিষিদ্ধ ষোড়শ, নিষ্পাপ, কলুষিত, বিষন্নতা, ওষ্ঠ, সম্মুখ, সম্মান, সংজ্ঞা, ব্যাখ্যা, আনুষঙ্গিক, রূদ্ধশ্বাস, দুর্নাম, অন্তঃস্থল, নগণ্য, আতঙ্ক, জটিল, গগণ, তিথি, অতিথি।

  *কিছু শব্দ স্বভাবতই মূর্ধন্য-ষ হয়।
চাণক্য মাণিক্য গণ              বাণিজ্য লবণ মণ 
 বেণু বীণা কঙ্কণ কণিকা।
 কল্যাণ শোণিত মণি             স্থাণু গুণ পুণ্য বেণী 
 ফণী অণু বিপণি গণিকা। 
আপণ লাবণ্য বাণী         নিপুণ ভণিতা পাণি
 গৌণ কোণ ভাণ পণ শাণ। 
চিক্কণ নিক্কণ তূণ     কফণি (কনুই) বণিক গুণ
 গণনা পিণাক পণ্য বাণ।

  * কিছু শব্দ স্বভাবতই মূর্ধন্য-ষ হয়।
যেমন: আষাঢ়, নিষ্কর, পাষাণ, ষোড়শ ইত্যাদি।
 কতগুলো শব্দ বিশেষ নিয়মে মূর্ধন্য-ষ হয়। যেমন: সুষুপ্তি, বিষম, বিষয়, দুর্বিষহ, যুধিষ্ঠির ইত্যাদি।

  মো: আফতাবুজ্জামান 
 সহকারী শিক্ষক, বাংলা বিভাগ
 বেইলী স্কুল, নারায়ণগঞ্জ।




২টি মন্তব্য: